#প্রিয়চিত্রসাথী নিউজ💐
১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ঃ*
ড. ভূপেন হাজরিকার কাছে কলকাতা কখনও শুধু একটি শহর ছিল না- এটি ছিল তাঁর সৃষ্টিশীলতার আশ্রয়, তাঁর দ্বিতীয় ঠিকানা, এবং সেই মঞ্চ, যেখান থেকে তিনি অসমের আত্মাকে সুরের ডানায় ভর করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে টালিগড়ে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল তাঁর এই শহরের সঙ্গে দীর্ঘ চার দশকের সম্পর্ক। তাঁর সেই ঐতিহাসিক বাড়ি আজ অসম সরকারের উদ্যোগে সংস্কার হয়ে এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পুনর্জন্ম নিতে চলেছে-যা হয়ে উঠবে ঐক্যের স্থায়ী প্রতীক।
এই উত্তরাধিকারই আবার জীবন্ত হয়ে উঠল ৮ সেপ্টেম্বর কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে।
ব্যতিক্রম, অসম সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক দপ্তর এবং ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম মিলে আয়োজন করেছিল ভূপেন শতবর্ষ উদ্যাপনের এক মহোৎসব।
অনুষ্ঠানের সূচনা হয় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও শিল্পীর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্পণের মাধ্যমে। তারপরই গোটা প্রেক্ষাগৃহে ধ্বনিত হল ভূপেনদার অমর গান 'মানুষ মানুষের জন্য'-যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে সেতুবন্ধনে বাঁধার এক আবেগঘন প্রারম্ভ।
পদ্মশ্রী পূর্ণদাস বাউল সম্রাট অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী করে, তাঁর আবেগভরা কণ্ঠে বলেন, "আজ আমার বয়স তিরানব্বই। হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই ভূপেন দার সঙ্গে দেখা হবে। আমি একজন বাউল, আমার জীবন দর্শন ভালোবাসা আর ভ্রাতৃত্বের বার্তা দেওয়া। ভূপেন দাও সেই একই সুর বাজিয়েছিলেন। তাই তো আজ আমরা সকলে একত্রিত হয়েছি- সঙ্গীত ও মানবতায়।"
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বহু অতিথি- কলকাতা প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশীষ সূর, শিল্পী ডলি ঘোষ, দোহার ব্যান্ডের রাজীব দাস, ইলুমিস ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা ড. রীমা দাস মল্লিক, ইঞ্জিনিয়ার প্রসাদ রঞ্জন দাস, ফ্যাশন ডিজাইনার সম্পা দাস, জেএমবি হেলথকেয়ার সিএও অনুপ ভক্ত, সেন্টার অফ ক্রিয়েটিভ অ্যান্ড পারফর্মিং আর্টস, এনএসএইচএম-এর প্রধান রীনা মিত্র, খ্যাতনামা বাউল শিল্পী দিব্যেন্দু দাস বাউল, লেখক নিশিত বরণ সিংহ রায়, প্রাক্তন আইএএস কর্মকর্তা ও সমাজকর্মী ড. স্বপ্ননীল বড়ুয়া, প্রাক্তন পর্যটন কমিশনার রাজবীর হুসেন, ব্যাঙ্কার গৌতম ভট্টাচার্য, ব্যতিক্রম ও লায়ন্স ক্লাব অফ গুয়াহাটি ব্যতিক্রমের সভাপতি ড. সৌমেন ভারতীয়া প্রমুখ।
স্বপ্ননীল বড়ুয়া বলেন, "ভূপেন হাজরিকা কলকাতায় যে ভালোবাসা পেয়েছিলেন, তা অনন্য। এখানেই তিনি শুধু গায়ক নয়, এক সাংস্কৃতিক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। আজকের অনুষ্ঠানে কোনও শিল্পী পারিশ্রমিক নেননি- কারণ প্রত্যেকেই মনে করেছেন, এটা তাঁদের হৃদয়ের অর্ঘ্য।”
স্নেহাশীষ সুর বলেন, "আমাদের প্রজন্ম 'ম্যাস কমিউনিকেশন' শব্দটির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয়েছিল ভূপেন হাজরিকার ডক্টরেটের মাধ্যমে। তিনি শুধু সংগীতে নয়, চিন্তায়, গবেষণায়ও পথিকৃৎ ছিলেন। তাঁর শিক্ষা আজও আমাদের নতুনভাবে ভাবতে শেখায়।"
এরপর একে একে মঞ্চে আসেন কিংবদন্তি শিল্পীরা-শ্রীকান্ত আচার্য, লোপামুদ্রা মিত্র, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, দোহর ব্যান্ড, অনুভূতি কাকতি গোস্বামী, জয়তী ভট্টাচার্য, কাশ্মিরি কোটোকী মল্লিক, মিঠুন ধর, মুসাফির ব্যান্ড, সৃজিতা মিত্র ভট্টাচার্য, ডলি ঘোষ, সর্বাণী ভট্টাচার্য প্রমুখ। তাঁদের কণ্ঠে ভূপেনদার গান যেন নতুন জীবন ফিরে পেল।
গান গেয়ে লোপামুদ্রা মিত্র বলেন, "আজ ভূপেনদার গান গেয়ে মনে হল যেন আমি নিজের ঘরে বসে গাইছি। তাঁর সুরে আছে মাটির গন্ধ, আপনজনের উষ্ণতা।"
শ্রীকান্ত আচার্য বলেন, "ভূপেনদার গান মানুষকে ভেতর থেকে নাড়া দেয়। তাঁর প্রতিটি সুরে এক অনন্ত নদীর স্রোত আছে-যা আমাদের সকলকে একসঙ্গে বয়ে নিয়ে চলে।"
দোহর ব্যান্ডের শিল্পীরা বললেন, "আমাদের কাছে ভূপেনদার গান শুধুই গান নয়, এগুলো লোককাব্য। প্রতিটি গানের ভেতরে লুকিয়ে আছে মানুষের গল্প, প্রজন্মের সেতুবন্ধন। তাঁর গান গাওয়া মানে যেন তাঁর সঙ্গে পথ চলা।"
অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে কলকাতার এনএসএইচএম নলেজ ক্যাম্পাসের ১০০ জন ছাত্র-ছাত্রীর সমবেত কণ্ঠে-যার সুরেলা ঐকতান সবাইকে স্তব্ধ করে দেয়। এক প্রবীণ শ্রোতা সমবেত গানের পর বলেন, "ভূপেন দার কণ্ঠে আমি আজও শুনি ব্রহ্মপুত্র আর হুগলীর মিলনধ্বনি। তিনি অসম ও বাংলার সমানভাবে আমাদের হৃদয়ের শিল্পী।"
তারপরই "ড. ভূপেন হাজরিকা ব্যতিক্রম আন্তর্জাতিক পুরস্কার ২০২৫" প্রদান করা হয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লাকে। তিনি উপস্থিত থাকতে না পারলেও পাঠালেন তাঁর আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
ভূপেন হাজরিকার উত্তরাধিকারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয় সঙ্গীতশিল্পী গৌর পাল ও সুরোজ বড়ুয়াকে, যারা একসময় ভূপেন হাজরিকার সঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। এছাড়াও আরও সম্মাননা প্রদান করা হয় অশোক চক্রবর্তী, ড. জুনমণি দেবী খাউন্ড, সোহেলি শীল সরকার, সীমা শর্মা, শ্যামশ্রী দাস গুপ্তা, শীলা দরিয়ানিকে।
ড. সৌমেন ভারতীয়া বলেন, "ভূপেন হাজরিকার গান ও চলচ্চিত্রের প্রতিটি সৃষ্টিই এক ঐক্যের বার্তা বহন করে। আজকের শতবর্ষ আয়োজন কেবল একটি স্মরণ নয়-এটি তাঁর স্বপ্নের ধারাবাহিকতা। অসম ও বাংলার মধ্যে যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন তিনি তৈরি করেছিলেন, আজকের সন্ধ্যা তারই পুনর্নবীকরণ।"
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৩ বছর ধরে ব্যতিক্রম ভুপেন হাজরিকার স্বপ্নকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে দেশ ও দেশের বাইরে। তবে কলকাতার এই শতবর্ষ সন্ধ্যা ছিল আলাদা। মনে হচ্ছিল, ভূপেনদা যেন ফিরে এসেছিলেন, প্রতিটি সুরে, প্রতিটি স্মৃতিতে, প্রতিটি অশ্রু আর হাসিতে।
রাত নামার পর প্রেক্ষাগৃহে ভেসে রইল এক অটল সত্য- ভূপেন হাজরিকা আমাদের ছেড়ে শুনি। তাঁর শতবর্ষ কোনও স্মরণ নয়-এ এক পুনর্জাগরণ। তাঁর গান এখনো কথা বলে, তাঁর বার্তা মনের ক্ষত সারায়, তাঁর উত্তরাধিকার আজও আমাদের পথ দেখায়।
0 Comments